শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
জাকিরুল আহসান।।
বাবার সংসারে অভাব আছিলো, অনেক কষ্ট করে আমাগো জন্য খাবার জোগার করতো। আমি যখন একটু বুঝতে থাকি তখন হইতেই কামাই রোজগারের চেষ্টা করি। ১২/১৩ বছর বয়সে গাড়ির হেল্পারি শুরু করি। সেই যে কষ্টের শুরু আর শেষ হয়নাই। এহন আমার বয়স ৯৮ বছর, কষ্টে কষ্টেই গেল আমার জীবন। বলতে বলতে কন্ঠ ভারী হয়ে আসছিল, বেশ কয়েকবার চোখের পানি সরিয়েছেন হাত দিয়ে। তিনি বরিশাল নগরীর ২৯ নং ওয়ার্ডের সুগন্ধা হাউজিং এলাকার সিদ্দিকুর রহমান রাঢ়ী।
সুগন্ধা হাউজিং এ প্রবেশ করার পর মনেই হবে না এই মহল্লায় এত দরিদ্র কেউ থাকতে পারে। বেশ কয়েকটি বাড়ির পর পুরনো একটি জরাজীর্ণ বাড়ি পাওয়া গেল। বাড়িটি বহু বছর আগের টিনসেট একতলা বিল্ডিং। দেয়ালের পলেস্তার খসে খসে পড়ছে, টিনগুলো ভাঙ্গাচোড়া। দেখে অনুমান করা যায় বৃষ্টি হলে পানি থেকে রক্ষায় কতটা চেষ্টা চলে জোড়া-তালি দিয়ে। এই বাড়িটিতেই গত ২০ বছর ধরে বাস করছেন সিদ্দিকুর রহমানের পরিবার। রূপালী বার্তার এই প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘আমাগো মতো মানুর খবর লেহার কেউ আছে বাবা!’
জানালেন, মাত্র ১২/১৩ বছর বয়সে গাড়ির হেলপারি শরু করেন সিদ্দিকুর। এরপর কাজ করেন বরিশালের ত্রিশ গোডাউনে, গ্রামে গ্রামে মাটিও কেঁটেছেন কয়েকবছর। শেষ দিকে রিকশার গ্রেজে কাজ করেছেন। ২০০০ সালে ব্রেইন স্ট্রোক করেন। চিকিৎসার জন্য কাশিপুর ইছাকাঠী গ্রামের ৬ শতাংশ জমির বাড়িটি বিক্রি করে দেন। আর বাড়ির জমি কেনার সাধ্য হয়নি। সেই থেকে ভাড়া বাসায় থাকেন। ৫ ছেলে মেয়ের মধ্যে ৩ ছেলে দিনমজুর। ছোট ছেলে রফিকুল ইসলাম ধরে রেখেছেন বাবার পেশা। তিনি রিকশার গ্রেজে কাজ করেন। আর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।
সিদ্দিকুর বলেন, ছোট ছেলে রফিকুলের সাথেই আছি। যেমন পারে তেমন খাওয়ায়। তারপরও আল্লাহ যা রাখছে বলতে হবে ভালো রাখছে। কিছুই আর আশা নাই। স্ত্রীর চিকিৎসা করাইতে পারি না। নাই ঘর, নাই বাড়ি, নাই ঠিকানা। তয় বাবার কথা রাখছি, বাবা বলছিল হারাম খাবা না, আমি হারাম রোজগার করি নাই, হারাম খাই নাই।
এই করোনাকালে ভয়ানক কষ্টে কেটেছে সিদ্দিকুরের। কোন সরকারি বেসরকারি সহায়তা পাননি তিনি। তিন মাস পরপর যে ১৫০০ টাকা বয়স্ক ভাতা পান, সেটিও পাননি। পাশের ২/১ টি বাড়ি থেকে যা পেয়েছেন, তা দিয়েই চলেছেন।
রফিকুল ইসলাম জানান, ঘর ভাড়া দিতে হয় ২ হাজার ৫০০ টাকা। ৩ ছেলে মেয়ের সবাই কিছু না কিছু পড়াশোনা করছে, ওদের খরচ। বাবা ৫ বার স্ট্রেক করেছে, চিকিৎসায় গেছে সাড়ে ৩ লাখেরও বেশি টাকা। সেই টাকা বিভিন্ন সমিতি থেকে লোন করে খরচ করেছেন, যার কিস্তি টানছেন এখনও। এরই মধ্যে গত রমজান মাসে মা মমতাজ বেগম স্ট্রোক করে বিছানায়। তার চিকিৎসায় খরচ হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। এখন বাবা-মায়ের ওষুধের খরচ মাসে ৩০০০। এই খরচের সবই বহন করতে হয় গ্রেজে কাজের আয় দিয়েই।
রফিকুল বলেন, কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দিন যাচ্ছে। পারি না ভালো কিছু খাইতে, পারি না সন্তানদের ভালো কিছু পরাইতে। মা বিছানায় পইড়া আছে। ভালো চিকিৎসা করাইতে পারি না। যেই কয়দিন আছে বাবা-মাকে তো দেখতে হবে। আর কোনদিন নিজেগো ঘর হইবো কি না জানি না। তয় সরকারি-বেসরকারি কোন সহায়তা পাইলে শেষ বয়সে বাবা একটু শান্তি পাইতো।